এয়ারপোর্টে বসে আছি একা…আশে পাশে বিভিন্ন ধরনের মানুষ। কেউ দেশি, কেউবা বিদেশি…ভিন্ন ধরনের মানুষ। তবে সবার মাঝে একটা কমন ব্যাপার আছে, আর সেটা হল স্বপ্ন। বলতে পারেন স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা কিংবা, স্বপ্ন দেখার সাহস। সাহস বলার পেছনের কারণগুলো বলব, কিন্তু ধীরে ধীরে। স্বপ্ন ও স্বাধীনতা, সেটা দিয়ে শুরু করি তবে।
মানুষ হিসেবে জন্মালেও আমাদের ভাবনা, জ্ঞান, চাহিদা কিংবা জীবনধারা সকল কিছুই নির্ভর করে জন্ম, পরিবার, লেখাপড়া আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। অবশ্যই, আমাদের জন্ম কোথায় হবে সেটা আগে থেকে নির্ধারণ করার ক্ষমতা আমরা রাখি না। কোন বাবা মায়ের সন্তান হবো, কিংবা কোন পরিবেশে বা দেশে জন্মাবো, সেটাও না। তবে, লেখাপড়া করবো কিনা, কি পড়ব, কেন পড়ব, পড়াশুনা করে ভবিষ্যতে কি করবো, সেসকল কিছু নির্ধারণ করার কিছুটা হলেও ক্ষমতা, ইচ্ছা, অবস্থা আমাদের সকলেরই থাকে।
অবশ্য অর্থনৈতিক টানাপোড়ন, পারিবারিক সমস্যা, বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের চাপ অনেকেরই নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু সেদিক বিবেচনা করলে, নিজের যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করা হবে বলেই ধারণা করা হবে। কারণ, হাজার বছরের ইতিহাস বিবেচনা করলে, দেখা যাবে, দারিদ্রতা, পারিবারিক অস্বচ্ছলতা অথবা মানসিক চাপ সকল যোগ্য মানুষের যোগ্যতা অর্জনের প্রাথমিক উপাদান হয়ে উঠেছিল। আজও অনেকে রিক্সা চালকের সন্তান হয়ে, ম্যাজিস্ট্রেট হবার পথে হাঁটেন। কোনো অবস্থানই তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছাকে নষ্ট করার ক্ষমতা রাখেনা। তাই স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা এবং সেটা পূরণ করার চেষ্টাই মানুষকে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলতে একমাত্র সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
স্বপ্ন পূরণের সাহস। ওই যে বললাম, কতো মানুষ আর কত রকমের অবস্থান। কিন্তু সেটাকে বাস্তবে রুপ দিতে হলে, সেটিকে অর্জন করার জন্য সকল বাঁধা বিঘ্ন পার হয়ে সামনে এগুতে হবে। কিভাবে? যিনি সাহসী, সাহস করবেন সামনে এগিয়ে যাবার, যেভাবেই হোক নিজের স্বপ্ন পূরণ করার, মাঝে যতই বাঁধা আসুক না কেন, সে এগিয়ে যাবেই। নিজের অবস্থান, যোগ্যতা কিছু ক্ষেত্রে লেখাপড়া তার গতিকে কোনভাবেই বাধাগ্রস্থ করতে পারবে না।
এবার চলে আসি নিজের গল্পে। ছিলাম কোথায়? এয়ারপোর্টে! যাচ্ছি… ফিলিপাইন্স আর কেম্বোডিয়া। দুটি দেশ যেখানে কাটাবো আগামী ৩৭ দিন! আইল্যান্ড হপিং করবো, সমুদ্রে সাঁতার কাটবো আর ঘুরে বেড়াবো। আমার শুরুটা এরকম কখনই ছিল না। খুব সাধারণ ঘরে জন্ম আমার। খুব অস্বচ্ছল কিংবা খুব স্বচ্ছল কোনটাই বলবো না। খালি বলবো, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা আর সাহস দুটিই ছিল। ঘুম থেকে উঠেই আমি মালয়শিয়া কিংবা ভিয়েতনাম চলে যাইনি। স্বপ্ন পূরণ করতে সময় লেগেছে ২৮ বছর, কিন্তু হয়েছে।
গল্পটা প্রথম থেকে শুরু করি। আমার ছোটবেলা থেকেই ফ্রেঞ্চ ভাষার প্রতি অনেক আকর্ষণ। সেখান থেকেই ভাষা শিক্ষার জন্য ভর্তি হলাম আলিয়ান্স ফ্রন্সেসে। দুঃখের ব্যাপার হল, শিখতে চাইলেই তো আর ভাষা শেখা যায় না! কারণ ভাষা শিখতে হলে সেই ভাষাভাষীর কারো সাথে কথা বলা অনেক জরুরী। ধরে নিতে পারেন, বাধ্যতামূলক। এক বন্ধুকে বললাম, ভাষা শিখতে সাহায্য করতে। সেও পরিচয় করিয়ে দিলো এক ফ্রেঞ্চ ভাষাভাষীর সাথে, যে আমার সাথে সেই ভাষায় কথা বলবে। কথা বলতে বলতে আমাদের মাঝে বেশ ভাব হয়ে গেলো, যা এক সময়ে ভালোবাসায় রুপ নিতে থাকলো। এবার অন্ন রকম দুঃখ! সে দেশে আসতে পারছে না, তাই আমাকে যেতে হবে।
যেই কথা সেই কাজ! হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম ফ্রান্স যাবো! কিন্তু যেতে হলে তো আমাকে আরও কিছু দেশে ভ্রমন করতে হবে নতুবা আমাকে ভিসা দিবে না। আমি বেশ কয়েকবার ইন্ডিয়া গিয়েছি, কিন্তু তার বাইরে কোথাও নয়। যেহেতু ইন্ডিয়া খুব কাছের দেশ তাই ইন্ডিয়াতে গেলে পাসপোর্টের খুব একটা অবস্থান পরিবর্তন হবে না। যেতে হবে উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে অর্থনীতি উন্নত। তাই শুরু করলাম মালয়েশিয়া দিয়ে। সেখান থেকে শ্রীলংকা তারপর ভুটান। তিনমাসে গেলাম তিন দেশে আর তারপর ফ্রেঞ্চ ভিসার আবেদন।
ভিসা আমার হলো না! ভেবে দেখুন তো? নিজের জমানো টাকা দিয়ে এত দেশে ঘুরে বেরিয়ে যখন ভিসাটা হল না, তখন আমার কি করা উচিৎ? এই পর্যায়ে আপনি কি করতেন?
আপনার উত্তরটি আপনি পারলে ভেবে দেখুন! আর আমারটা শুনতে থাকুন…
আমি ততদিনে অনেক মানুষ, ভিন্ন দেশ, সংস্কৃতির প্রতি একটা মোহে পরে গিয়েছি। ভালোবেসে ফেলেছি সেই ভিসা, টিকেট, ফ্লাইট, নতুন নতুন ভাষার। শুরুতে কোন দেশে ৫ থেকে ৬ দিনের বেশি থাকা হতো না, আর এখন আমি ২০ থেকে ২৫ দিনের আগে ঘরে ফিরে আসি না। কারণ এটা না যে, আমার অনেক টাকা। কারণটা হল কিভাবে অল্প টাকায় বেশি ঘুরে বেশি অভিজ্ঞতা নেয়া যায়, সেই বিষয়ে আমি দিনে দিনে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছি। ঘুরে ঘুরে অর্জন করছি নতুন নতুন গল্প যা দিয়ে তৈরি করেছি নিজের ট্র্যাভেল ব্লগ।
শুধু তাই নয়, দেশের পর্যটনকে কিভাবে আরও উন্নত করা যায়, সেটা নিয়েও কাজ করার পথে হাঁটছি আমি। নিজের ভ্রমন ব্লগ চালিয়ে সকলকে বাংলাদেশে এসে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানোর জন্য সাহায্য করি। ইচ্ছা আছে, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো…সকলকে উৎসাহ দিবো, জীবনকে জানার, দেখার।
এত ঘটনার পর জানতে ইচ্ছা হচ্ছে না, যে আমার সেই ফ্রেঞ্চ বন্ধুর কি হল? সেটা অন্যদিন বলবো। হয়ত আপনাদের জানার আগ্রহ থাকলে, আপনারা আমাকে লিখেবন।
এবার বলি আরও পুরানো ইতিহাস! আমার বন্ধুদের মাঝে অনেকেই যখন বিদেশে ঘুরে আসার গল্প বলতো, তখন আমার হিংসে হতো না। আমি মনে মনে ভাবতাম, যেদিন নিজের যোগ্যতা হবে, সেদিন অবশ্যই যাবো। আর যা করতাম, সেটা হল পড়াশুনা। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যে আরও কিছু জানার আছে, সেটিকে কাজে লাগাতাম। কেউ আমার সামনে বিদেশে যাবার, ভিসার কথা বলা শুরু করলেই আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, জানতে চেষ্টা করতাম। তখনও জানতাম না, কবে যাবো, কিভাবে যাবো। কিন্তু এতটুকু বিশ্বাস ছিল নিজের উপর যে একদিন হয়তো দেখা হবে বিশ্ব। হচ্ছেও… তার একটা বড় কারণ স্বপ্ন দেখার সাহস।
শুধুমাত্র জীবন নিয়ে অভিযোগ না করে স্বপ্ন দেখে, সেটাকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা মানুষকে অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি দেয়, যা অন্য সকল নেতিবাচক ক্ষেত্র থেকে অনেক মূল্যবান। দুঃখ থাকে সকলেরই কিন্তু বাঁধা ভেবে সেটাকে টপকিয়ে সামনে এগুনোর নাম স্বপ্ন পূরণ। আমাদের সকলের স্বপ্ন আলাদা আর তাই প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন মিলিয়ে একটা স্বপ্ন পূরণের জীবন, অতৃপ্তি, না পাওয়ার কষ্ট থেকে অনেক বেশি শান্তির।
বাঁধা আসবেই, কিন্তু সেটা সাময়িক! পার হতে চাইলে আপনি অবশ্যই সফল হবেন। নতুবা এপারে বসে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত আফসোস করবেন। সুতরাং ভাবুন, আমার মতো স্বপ্ন পূরণের সাহস দেখাবেন? নাকি স্বাধীন হওয়া সত্তেও পরাধীন জীবনযাপন করবেন।
No Comments